শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪

বিএনপির আপত্তি সত্বেও সংসদে ইসি গঠনের খসড়া

 

বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদের আপত্তির মুখে নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে করা আইনের খসড়া সংসদে বিল আকারে তোলা হয়েছে। আজ রোববার (২৩ জানুয়ারি ২০২২) কণ্ঠভোটের মাধ্যমে বিলটি সংসদে উত্তাপনের জন্য অনুমতি পান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য আইন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়। সংসদীয় কমিটি প্রতিবেদন দেওয়ার পর তা সংসদে পাসের জন্য তোলা হবে।

অত্র বিলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের প্রক্রিয়া ও যোগ্যতা-অযোগ্যতা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত আইনে তিনটি যোগ্যতা এবং ছয়টি অযোগ্যতার কথা বলা হয়েছে।

এতে বলা হয়েছে, সিইসি ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগের জন্য প্রতিটি পদের বিপরীতে দুজনের নাম প্রস্তাব করার জন্য একটি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করবেন রাষ্ট্রপতি। অনুসন্ধান কমিটির সভাপতি হবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত আপিল বিভাগের একজন বিচারপতি। আর সদস্য হিসেবে থাকবেন প্রধান বিচারপতির মনোনীত হাইকোর্টের একজন বিচারপতি, মহাহিসাবনিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক, সরকারি কর্ম কমিশনের চেয়ারম্যান এবং রাষ্ট্রপতির মনোনীত দুজন বিশিষ্ট নাগরিক। তিনজন সদস্যের উপস্থিতিতে অনুসন্ধান কমিটির সভার কোরাম গঠিত হবে। সভায় উপস্থিত সদস্যদের সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। ভোটের সমতার ক্ষেত্রে সভায় সভাপতিত্বকারী সদস্যের দ্বিতীয় বা নির্ণায়ক ভোট প্রদানের ক্ষমতা থাকবে।

এর আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, বিএনপি নিজেরা নির্বাচনে জয়ী হতে ১ কোটি ৩০ লাখ ভুয়া ভোটার করেছিল। নিজেদের পছন্দের মানুষকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করতে বিচারপতিদের বয়স বাড়িয়েছিল। এগুলো কারও সঙ্গে আলোচনা করে করা হয়নি। আলোচনার প্রয়োজনও মনে করেননি। কারচুপি করে ক্ষমতায় আসার জন্য এসব করেছিল বিএনপি।

আইনমন্ত্রী বলেন, সংবিধানে বলা আছে, নির্বাচন কমিশন গঠনের জন্য আইন করতে হবে। আমরা সেই আইন করেছি। ওনারা বুঝে বলুন না বুঝে বলুন, বলছেন এটা সার্চ কমিটির আইন। ওনারা বলছেন, আইনটা আমরা ঠিক করিনি। ওনাদের সঙ্গে আলোচনা করিনি।

আইনমন্ত্রী আরও বলেন, সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) এনজিও আমার কাছে একটি ড্রাফট দিয়েছিল। যখন আমি বলেছিলাম, এই সংসদে পাস করে, কোভিড সিচুয়েশনের জন্য, এই সংসদে পাস করা করা সম্ভব হবে না, অন্য কিছু না, কোভিড সিচুয়েশনের জন্য। প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সালেই বলেছিলেন, এই আইন করা প্রয়োজন। ওনারা বলেছিলেন, অরডিন্যান্স করে আইন করে দিতে হবে। আমি বলেছিলাম, এই আইন সংসদে না এনে করা ঠিক হবে না। সকলের সঙ্গে আলোচনা করে সংসদে তার পরে করা উচিত।

এর আগে বিএনপির সাংসদ হারুন বলেন, অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গত দুটি নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। এর আগে অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে গঠিত দুটি কমিশনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য এই আইন আনা হয়েছে। এখানে নতুনত্ব কিছু নেই। এর আগে যে কমিশন গঠিত হয়েছে, তার অনুরূপ বিল এখানে তোলা হয়েছে। তিনি বর্তমান কমিশনের সদস্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।

সাংসদ হারুন আরও বলেন, এ আইন প্রশ্নবিদ্ধ। এ আইন দিয়ে বর্তমান সংকটের নিরসন হবে না। সংকট থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব না। আমি দাবি করব—আইনটি প্রত্যাহার করুন। আইনমন্ত্রী কিছুদিন আগে বলেছিলেন, এ রকম একটি আইন প্রণয়নের জন্য রাজনৈতিক দল ও সুধীসমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে। এ কথা বলার পর তিনি কী করে এ আইন আনেন?

হারুনের বক্তব্যের জবাবে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও খসড়া আইনের বিভিন্ন ধারা পড়ে ব্যাখ্যা করেন। আইনমন্ত্রী কথা বলার সময় তাঁর সামনের আসন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আনিসুল হককে বিভিন্ন বিষয় মনে করিয়ে দেন। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের উদাহরণ তুলে ধরে আইনমন্ত্রী বলেন, কোথাও এ রকম স্বচ্ছভাবে ইসি গঠন করার পদ্ধতি নেই। এই আইন হলে এবং এর মাধ্যমে ইসি গঠিত হলে বিএনপি চুরি করতে পারবে না, এ জন্য তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ বিল ২০২২’ জাতীয় সংসদে উত্থাপন করেন। আইনটি উত্থাপনের বিরোধিতা করে বিএনপির সাংসদ হারুনুর রশীদ বলেন, ‘যে বিল আইনমন্ত্রী এনেছেন, তা জনগণের প্রত্যাশা, রাজনৈতিক দলগুলোর এবং সুশীল সমাজের যে প্রত্যাশা, তার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। আমরা দীর্ঘদিন যাবৎ নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য একটি আইন প্রণয়নের আহ্বান জানিয়ে আসছিলাম। আজ আইনমন্ত্রী যে বিল উত্থাপন করেছেন, ইতিমধ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সুশীল সমাজ গণমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে। বিএনপির পক্ষ থেকে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলা হয়েছে—“যাহা লাউ, তাহাই কদু”।

আইনমন্ত্রী অনুসন্ধান কমিটি গঠনে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের উদ্যোগের প্রেক্ষাপট তুলে ধরে বলেন, তখন একটা কনসেনশাস হয়েছিল। তখন গেজেট হলো। নির্বাচন কমিশন গঠন করা হলো। পরেরবার আবার একইভাবে হলো। এটা আইন ছিল না, কিন্তু এটা ছিল ফোর্স অব ল। কারণ, এটি রাষ্ট্রপ্রধান করেছিলেন। রাষ্ট্রপ্রধানের চেয়ে বড় কেউ না। তখন বিএনপির আপত্তি ছিল না।

আনিসুল হক বলেন, মহামান্য রাষ্ট্রপতি যে দুবার সার্চ কমিটি করেছেন, সেটাও আইনসিদ্ধ ছিল। সেটাও আইনের আওতায় আনা হলো। এটা কনসেনশাসের ভিত্তিতে করা হয়েছিল। ওনাদের কথা হচ্ছে, যা করেন করেন, তালগাছ আমার। তালগাছ ওনাদের না। তালগাছ জনগণের। ওনারা না বুঝে বলছেন। আইনটা যখন করে ফেললাম, পালের হাওয়া চলে গেছে। সে জন্য এখন কী বলবেন। এইটা নাই, ওইটা আছে। ওইটা নাই, এসব নাচগান শুরু করে দিয়েছেন।

বিএনপির সমালোচনা করে আইনমন্ত্রী বলেন, ওনারা চান ওনাদের পকেটে যে নাম, সেই নাম দিয়ে ইসি গঠিত হবে। সেটা হবে না। এটা বাংলাদেশ। জনগণ ঠিক করবে। কোনো দল অগ্রাধিকার পাবে না।

আইনমন্ত্রীর বক্তব্যের সময় বিরোধী দলের আসন থেকে হারুন কথা বলা শুরু করলে আনিসুল হক বলেন, ওনারা (বিএনপি) না শুনলে শিখবেন কীভাবে। বুঝবেন না, শিখবেন কী?

অনুসন্ধান কমিটির গঠনের প্রক্রিয়া সম্পর্কে আইনমন্ত্রী বলেন, কমিটির চারজন সাংবিধানিক পদের অধিকারী। রাষ্ট্রপতি ইচ্ছা করলেও চাকরিচ্যুত করতে পারবেন না।

বর্তমান নির্বাচন কমিশনের অনিয়মের বিচারের দাবি প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী বলেন, আগে আজিজ কমিশনের বিচার করতে হবে। ১ কোটি ২৩ লাখ ভুয়া ভোটারের বিচার করতে হবে। এত তাড়াতাড়ি তিনতলায় ওঠা যাবে না।

নির্বাচন কমিশনার হতে যোগ্যতা অযোগ্যতা
আইনের খসড়ায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য তিনটি যোগ্যতার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো বাংলাদেশের নাগরিক হতে হবে, ন্যূনতম বয়স ৫০ বছর হতে হবে এবং গুরুত্বপূর্ণ সরকারি, আধা সরকারি, বেসরকারি বা বিচার বিভাগীয় পদে কমপক্ষে ২০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। এসব যোগ্যতা থাকলে প্রধান নির্বাচন কমিশনার বা নির্বাচন কমিশনার হতে পারবেন।

আর এসব পদে নিয়োগে অযোগ্যতা হিসেবে বলা হয়েছে, দেউলিয়া ঘোষিত হওয়া, বিদেশি রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব থাকা বা আনুগত্য প্রকাশ করা (তবে দ্বৈত নাগরিক হলে হওয়া যাবে), নৈতিক স্খলন হলে এবং ফৌজদারি অপরাধে অন্যূন দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সাজাপ্রাপ্ত হলে বা প্রজাতন্ত্রের কোনো লাভজনক পদে অধিষ্ঠিত থাকলে কোনো ব্যক্তি সিইসি বা নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ লাভের যোগ্য হবেন না।

এই শাখা থেকে আরও পড়ুনঃ

সর্বশেষ আপডেট